সুরের ধারা

আমরা গান গেয়ে গেলাম

আমরা গান গেয়ে গেলাম

‘আমরা গান গেয়ে গেলাম, তোমরা সুন্দরকে খুঁজে নাও’।
কথাটি লিখেছি এক দল শুভেচ্ছার্থি নতুন বন্ধুদেরকে, যখন তারা দেখা করতে আসেন কিছুদিন আগে। এক কথা সবাইকেই। চলে যাওয়ার আগ্মুহুর্তে একজন বললেন, সুন্দর কে তা তো বললেন না। বললাম, আমার লেখার মধ্যে খুঁজে নিও।

সুন্দর সবার মধ্যেই বিরাজ করে, বিশেষ করে মা। মা-র সদ্গুণগুলো কেউ বিচার করে না, অথচ সেখান থেকেই শিক্ষার শুরু। সরল, সর্বংসহা, চিরদিনের, সদাপ্রফুল্ল মা, নিজকে বিলিয়ে দেয়ার জন্যে সদা প্রস্তুত, এই সৌন্দর্য কেবল মায়ের। কবি বলছেন: মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখ আসে জল ভরে। মার কথা বলতে চোখে পানি আসে না, সে কেমন ছেলে, কেমন মেয়ে। মার সঙ্গেই প্রাথমিক সম্পর্ক যার গভীরতা পায় নি, কেমন করে সে যাবে আরও মহতের দরবারে। বাল্য শিক্ষা যে পড়ে নি, পড়েও হৃদয়ঙ্গম করে নি, সে কি করে স্পর্শ করবে মহৎগ্রন্থ। মনে পড়ে গ্রামের স্কুলে পড়েছিলাম: সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে। সারা জীবন এইটি আমার সুন্দরের আবাহন।

সব লেখায় পিতা। তা তো আসবেই, যদি পিতা হন আব্বাসউদ্দিন। এমন পিতা ক’জনের ভাগ্যে হয়। আবার সব পিতাই আমার পিতার মত শ্রেষ্ঠ। তাদেরকে অবহেলা করা আর সুন্দরকে অবহেলা করা একই কথা। যারা পিতার অবাধ্য, তারা মানুষ নামের যোগ্য নয়। একজন পিতা তার পুত্র কন্যার জন্যে সারা জীবনের পরিশ্রম কবুল করেন। ছেলেমেয়েরা যখন এই দানকে অস্বীকার করেন, অসুন্দর এসে বাসা বাঁধে তাদের জীবনে। অনেক পিতাকে চিনি, পুত্রের অসুন্দরের প্রতি লিপ্সায় ক্রন্দনরত। অনেকদিন আগে বায়তুল মোকাররম মস্জিদে একজন নামাজি পাশেই বসে সালাত আদায় করছিলেন। বললেন, খবরের কাগজে যে অপরাধির ছবি বড় করে ছাপা হয়েছে স্ত্রী হন্তা হিসেবে সেই ছেলের বাবা আমি। ভাবুন, এই পরিচয় দিতে তার কত কষ্ট হচ্ছিল। অথচ তার দিকে তাকিয়ে মনে হল ফেরেশতার মত। এটা সম্ভব হয়েছে সন্তানের প্রতি পরিপূর্ণ পরিচর্যার অভাবে। তাহলে পিতা-মাতারও প্রয়োজন দেখে নেয়া সে ভাল জিনিসে আকৃষ্ট হয়েছে কিনা, মহাগ্রন্থগুলো আয়ত্ত্বের মধ্যে কিনা, প্রভুর সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে কিনা। এটাই দেখে নেয়ার, প্রকৃত শিক্ষা যাচাইয়ের মুহুর্ত।

শিক্ষাগুরু, জগদ্গুরু, প্রশংসিতের প্রতিফলন থাকতে হয় জীবনে, চিন্তায়, চেতনায়, স্বভাবে, আচরণে। সমাজে দেখছি তাঁর কথার আলোচনাই সবচেয়ে কম। সভা থেকে নামটি বিতাড়ন করার জন্যে শিক্ষিতজনেরা প্রস্তাব দিয়েছেন জাতির সামনে। আমার মতে এটি আত্মহত্যাকারিদের প্রস্তাব। তিনি কাউকে দুঃখ দেন নি, কোন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেন নি। সবাইকে বুকে আলিঙ্গণ করা, এটাই শিক্ষাগুরুর লক্ষ্য। পাড়ার প্রতিটি মানুষ যেন আমাকে ভালোবাসে। আমি যেন সবার কাছে প্রিয় হই। সুন্দরের আবাহনে প্রবেশ করেছি।

হাতে একটি গ্রন্থ, যাতে লেখা:
পরম সুখের বেহেশতি বাগানে সেই প্রবেশাধিকার পাবে, যার হৃদয় সত্য, পবিত্র ও ক্ষমার আঁধার। পৃথিবীর রূপ মধুর, নয়নের কাছে তা সবুজ এ কথা সত্যি। প্রভু তোমাদেরকে এনেছেন পূর্ববর্তীতের মৃত্যু পরই, অতএব, তোমরা কর্মেই থাক সদা সতর্ক। বিলাস ও পাপ থেকে দূরে থেক। প্রভুর কাছে তারাই ভাল, যারা আপন পরিবারের কাছে ভাল। সত্যিই জেন, নিজের সন্তানকে সুন্দরের পথে একটি আদর্শ পৌঁছে দেয়া আর এক বস্তা শস্যকণা ভিক্ষা দেয়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাল। কোন পিতাই তার সন্তানকে আদব শিক্ষার চেয়ে আর কোন উৎকৃষ্টতম শিক্ষা দিতে পারেন না। আমার আদর্শ হল: আকাশ থেকে নেমে আসা অজস্র বৃষ্টির ধারার মত। তার মধ্যে কিছু অনুকুল মাটিতে যে বারিধারা নামে তাতে জন্ম হয় তৃণরাজি, কিছুটা গর্তে জমে তা মানুষের নানা উপকারে আসে; কিন্তু তা যদি পতিত হয় অনুর্বর মালভূমিতে তাতে কোন উপকার নেই। প্রথম দৃষ্টান্ত যে শিক্ষা মেনেছে আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির যে এটা মানে নি।

সুন্দরের আবাহন প্রকৃতিতে। নদীর কাছে যাই, বাতাসের কাছে যাই। মন হবে প্রফুল্ল, দৃষ্টি হবে স্বচ্ছ। সৃষ্টি নিয়ে ভাবি, সম্পর্ক নিয়ে ভাবি। অপরের দুঃখে চোখে পানি আসে সেই হৃদয়ের অন্বেষণ করি। খুঁজলে এই হৃদয়েই সেই পরানুভূতি, সহানুভূতি এসে বাসা বাঁধবে। যে তিনদিন খায় নি, তার কষ্টটি কি, যার পরনে কিছু নেই, তার অনুভূতিটি কি, যার মাথায় চাল নেই, তার জীবন কত দুর্বিসহ। এই বোধটি যার আসবে সে সুন্দরকে তত কাছে পাবে। তার জীবনে আসবে অভুতপূর্ব বেদনার অনুভূতি। বেদনাই সুন্দরের আবাহন। যার মনে বেদনা নেই, সে সুন্দরের পেছনে ছুটলেও সুন্দর তাকে দেখা দেবে না। যারা গরীব তাদের কাছেই সুন্দর আগে ধরা দেয়। মহাপুরুষরা গরীবদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন নি, বরং তাদের পাশেই ঠেস দিয়ে বসেছিলেন ঘন্টার পর ঘন্টা। আমাদের মধ্যে গরীবরাই সর্বোৎকৃষ্ট। অথচ সমাজে ওদের স্থান নেই। গরীবদের অন্বেষণ করুন, ওদের মধ্যেই সুন্দর বসে আছেন।

শিক্ষাঙ্গণগুলো পেরিয়ে এসেছি। গ্রামের স্কুল, ছোট শহরের স্কুল, কলকাতার স্কুল, ঢাকার নামকরা স্কুল, নামকরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। যে সার্টিফিকেট করায়ত্ত্ব, তাতে জীবিকা পেয়েছি শুধু। সেখানে সুন্দর খোঁজার প্রচেষ্টা দেখি নি। শ্রেষ্ঠ মানব যারা, সেখানে অপাংতেয়। তারই ফলশ্রুতি খবরের কাগজ জুড়ে: এসিড নিক্ষেপ, ফেন্সিডিলের প্রবাহে সারা মাঠ-ঘাট-পথ পিচ্ছিল, জমি নিয়ে কলহে ভ্রাতার শিরোচ্ছেদ, মাতৃ অবমাননা [ইভটিজিং] র মত অসুন্দর বার্তাগুলো।

ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ক’বছর কাজ করেছি বহিরাগত উপদেষ্টা হিসেবে। কঠিন অপরাধ কর্মে লিপ্ত বিশেষ সেলে আটককৃত কয়েকজন আসামীকে গান গেয়ে শোনাই: কারো মনে তুমি দিও না আঘাত, সে আঘাত লাগে কা’বার ঘরে। মানুষেরে তুমি যত কর ঘৃণা খোদা যান তত দূরে সরে। একজন সেন্ট্রি বললেন, বেড়ি পরান লোকটির বেশি কাছে যাওয়া আপনার উচিৎ হয় নি, কারণ সে ভয়ংকর আসামী। বললাম, সবাই আসামী, কেউ জেলের ভেতর, কেউ বাইরে।

মাতৃ অবমাননা, এসিড নিক্ষেপ, ফেন্সিডিলের আওতায় জাতির তারুণ্যকে করছেন কলুষযুক্ত, তারা সেন্ট্রাল জেলের বাইরেই ঘোরাফেরা করছি। উত্তর আপন হৃদয়ে: সুন্দরের কাছে সিজ্দায় সমর্পণ। সুন্দর এসে ধরা দিয়েছে অতি নিকটে।

২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সাহিত্যিক-সংগীত ব্যক্তিত্ব

Share this content: