জীব ও জগৎ

দুর্লভ ছত্রাক, সোনার চেয়ে দামী

দুর্লভ ছত্রাক, সোনার চেয়ে দামী

হিমালয়ের উত্তরে বরফের চাদরে মোড়া, বছরে আট মাস বরফে ঢেকে থাকা তিব্বত পৃথিবীর উচ্চতম স্থান যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০০ ফুট। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই তিব্বত।

চিত্র ১

আকাশফোড়া উঁচুতে শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে গিরিরাজ অপেক্ষমাণ।  দূরে তুষারাবৃত পর্বত শৃঙ্গ। পর্বতের পরতে পরতে আকাশের নীলাভ ছটা সূর্যের দিপ্তির সাথে মিশে নদীর বিশাল জলরাশিকে দৃশ্যময় করে তোলে। গিরিখাদ, জলপ্রপাত, ঝর্না, নদী, ওক, পাইন, রোডডেন্ড্রোন এবং চেস্টনাট বৃক্ষের সারি আর অপেক্ষাকৃত সমতল চারণ ভুমি সবকিছু দিয়েই নান্দনিক সাজে বিধাতা সাজিয়েছে নৈসর্গিক তিব্বতকে।  বরফের শ্বেত চাদরে ঢাকা পর্বতগুলো অবিরাম ভেসে আসা পেজা-তুলো-মেঘের কোমল ছোঁয়ায় যেন রূপকথার রাজ্য।

চিত্র ২

বিশাল নীল আকাশে ডানা মেলে বিচরনরত ক্লান্তহীন শঙ্খচীল। কোথাও যেন হারিয়ে যেতে নেই মানা।  

তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পর্বতের গায়ে জমে থাকা বরফ গলে ঢালু বেয়ে ঝর্না  হয়ে কল কল শব্দে বয়ে চলে নদীতে মেশার লক্ষ্যে।

মেকং, সালওয়িন, ইয়াংজি (এশিয়ার দীর্ঘতম নদী), সাংপো এবং ব্রহ্মপুত্রের মত বিশাল নদীগুলোর উৎপত্তি এই তিব্বত । তিব্বতের নদীগুলো হিমালয়ের উঁচুতম পর্বত থেকে উৎপত্তি হয়ে চীন, ভারত এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উপত্যকার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। স্রোতের নাবিতে পানি দূষিত হয়ে গেলেও উৎপত্তি স্থলে বেশ বিশুদ্ধ।  খনিজসম্রিদ্ধ বিশাল জলরাশীর উৎস হওয়ায় তিব্বতকে water tower of Asia নামেও ডাকা হয়ে থাকে। নদীগুলোর পানি  চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল এবং বার্মার মত জনবহুল দেশগুলোতে বয়ে চলেছে ।

এই পাহাড়িয়া দেশে গাছের বণ্টন বিন্যাস বড়ই বিচিত্র। ১২০০০ ফুট  উচ্চতা পর্যন্ত ওক, পাইন, চেস্টনাট, আর রোডডেন্ড্রন মত  বৃক্ষের দেখা মেলে । আরও উচুতে এদের আর দেখা পাওয়া যায় না। এমন উঁচুতে পাতলা এবং শুস্ক আবহাওয়া বৃক্ষের জীবন ধারনের জন্য মোটেই অনুকুলে নয়।  পর্বতের ঢালু আর সমতল ভুমি জুড়ে চোখে পরে গুল্ম আর ঘাসের মত ছোট ছোট গাছ পালা।  পাহাড় আর পর্বতে গড়া নৈসর্গিক তিব্বতের এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে সমতল চারণনভুমি যা Alpine meadow বা Alpine plateauনামে পরিচিত। পৃথিবীর উচ্চতম সমতলভূমি হওয়ায় তিব্বতকে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়। শীতের শেষে বরফ গলার সাথে সাথে চারণ ভুমি গুলো ক্রোকাস আর টিউলিপের মত রংবেরঙের ঘাস ফুলে ছেয়ে যায়।

পুরো চারণ ভুমি মেতে উঠে রঙের খেলায়। লোমশ মেষ সাদৃশ্য ইয়াক গুলো বিচরণ করে চারণভূমিতে।

চিত্র ৫

এই চারণভুমিতে যাদের বসবাস প্রকৃতির মতই সহজ সরল তাদের জীবন। খোলা মাঠে ইয়াকের লোম বা সাদা ক্যানভাসে তৈরি তাবুতে কেটে যায় এদের যাযাবর জীবনের অনেকটা সময়। ছাগল, মেষ আর ইয়াক চড়িয়ে চলে তাদের জীবিকা নির্বাহ।  প্রতিকূল অতি-নিম্ন তাপমাত্রার কারনে চাষাবাদ তেমন সুবিধের হয় না এই চারনভুমি গুলোতে। কখনও কখনও গ্রীষ্মেও তুষারাপাত হতে দেখা যায়।  তিব্বতের উত্তরের সমতলভূমিগুলো উষ্ণতর থাকায় সেখানে গম, বার্লি, আলু, মটর, ধান, শালগম, ভুট্টা, সরিষা, মুলা, মিষ্টিকুমড়া, রেড  পিপার,  এসবের চাষাবাদ চোখে পরে।  নদীর উপত্যকা ঘেঁষে বেড়ে উঠে আপেল আর ওয়ালনাট গাছ। স্থানীয় অধিবাসীদের প্রিয় খাবার বার্লি দিয়ে তৈরি সাম্পা, মেষ, ছাগল আর ইয়াকের মাংস, দুধ থেকে তৈরি দৈ, মাখন আর ঘি  আর মাখন চা। মাখন চা এদের অতিব প্রিয় পানীয়।

  সকালে কয়েক বাটি মাখন চা না খেলে এদের চলেনা। এই ঠাণ্ডার দেশে মাখন চা তাদের উষ্ণ রাখে আর সাথে সারাদিন মাঠে কাজ করার শক্তি যোগায়। এই মাখন চা সাম্পা দিয়ে খাওয়া এদের অনেকদিনের প্রচলিত প্রথা। সাম্পা হোল ভাজা বার্লির ছাতু।

আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে শরীর শীতল রাখতে ঠাণ্ডা পানিতে যবের ছাতু গুলিয়ে খাওয়ার যেমন রেওয়াজ অনেকটা তেমনি।

এই এ্যালপাইন চারণভূমিতে বসবাসকারী তিব্বতীয়দের জীবন ধারন নিতান্তই সাদামাটা। পার্থিব বিলাস নেই এদের।  দিন এনে দিন খেয়ে দিনাতিপাত। এমনি সাধারন জীবনধারী তিব্বিতিয়রাও যে বাড়তি আয় আর সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখেনা এমন কিন্তু নয় । তাই এদের বাড়তি আয়ের জন্য উবু হয়ে  সুই খোঁজার মত করে সারা মাঠে ভাগ্য ফেরানোর চাবিকাঠিটি হন্যে হয়ে খুজতে দেখা যায়।

এই চাবিকাঠি পাওয়া না পাওয়ার উপর নির্ভর করে তাদের ভালথাকা। স্বপ্ন দেখে তাবু আর মাটির ঘরের জায়গায় দালান বাড়ী,  মোটর সাইকেল, রঙিন টেলিভিশন, রিফ্রিজিরেটারএমনি আরও কত কি।  কি এই চাবিকাঠি?

মেয়েটির মুখে উল্লাস। ঘাস-মাঠে উবু হয়ে কি যেন খুঁজছিল। খুঁজছিল ঘাস্ফুলের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা  আকাঙ্খিত দুর্লভ ছত্রাক। শীতের শেষে এই ছত্রাক গুলো উঁকি দেয় মাটি ফুঁড়ে । অতি যত্নে আলতো করে মেয়েটি তুলে নেয় দেশালাই এর কাঠির মত নাজুক ছত্রাকটি। একটু ভেঙ্গে গেলেই দাম পরে যাবে। হাতে নিয়ে তুলতুলে ব্রাশ দিয়ে লেগে থাকা ধুলো মাটি গুলো ঝেড়ে নেয়। অনাবৃত হয় সোনার চেয়ে দামী হাল্কা হলুদ বর্ণের ছত্রাক টি। ছত্রাকটির স্থানীয় নাম ইয়ারসা গুনবু। যার অর্থ দাড়ায় গ্রীষ্মের ঘাস, শীতের পোকা। শরৎ কালে এই ছত্রাকের স্পোরগুলো মাটির নীচে বাস করা বাদুড় পতঙ্গের (bat moth) শুঁয়া পোকা গুলোকে আক্রমন করে। আস্তে আস্তে পুরো পোকাটাকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে বাসা বাধে ভেতরে । পোকার খোলসের আবরণের ভেতর বিস্তার করে এই ছত্রাক। বসন্তের আগমনে মৃত পোকার মাথা ফুঁড়ে ছত্রাকটি গজিয়ে উঠে মাটি ভেদ করে।

 আর এই সময়টাই যে তিব্বতীয় যাযাবরদের বাড়তি আয়ের মোক্ষ্যম সময়। বাবা মায়ের সাথে সাথে ছেলে পেলেরাও যোগ দেয় এই ভাগ্য-ফেরানো চাবিকাঠির সন্ধানে। এই বাড়তি উপার্জনে পিতা মাতাকে সহায়তা করতে স্কুল পর্যন্ত বন্ধ দিয়ে দেয়া হয়।

এই মুল্যবান ছত্রাকটির নাম শুয়োপোকা ছত্রাক (caterpillar fungus)।

বৈজ্ঞানিক নামOphiocordyceps sinensis। স্বর্ণের চেয়ে দামী এই ছত্রাক। পাইকারি ক্রেতা একটি ছত্রাক কম করে হলেও $3 দিয়ে কিনে বাজারে$10 করে বিক্রি করে।  ম্যাচকাঠির মত এই ছোট্ট ছত্রাকটি কেন এমন দামী?  প্রধানতঃ চীনাদের প্রচলিত পথ্যে এর ব্যবহারের কারনেই মুল্য আকাশচুম্বী।  অতিমুল্যের কারনে এটা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার হয়ে আসছে। আমেরিকার লাসভেগাসে এই ছত্রাকের সুপ ৭০০ ডলারে বক্রি হয় বলে জানা যায়, যার সমমূল্য  দেশী মুদ্রায়

টাকা ৬০,০০০ ,  আর এই সুপটিই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সুপ।

সনাতন যুগে অভিজাত ও রাজ পরিবারে এর ব্যবহারের কথা শোনা যায়। কিডনির টনিক হিসেবে এর বেশ যশ আছে। পরিক্ষা নিরীক্ষায় প্রমানিত হয়েছে কিডনির বিষাক্ত দ্রব্যগুলো কমিয়ে আনতে এটা দারুন কার্যকর। এরা শরীরের ইম্মুন সিস্টেম কে উদিপ্ত করে এবং দেহের কোলেস্টেরল কমায়। এছাড়া এ্যাজমা, ক্রনিক ব্রংকাইটিসের নিরাময় এবং যৌন শক্তি বর্ধক হিসেবেও এই ছত্রাকের টনিক ব্যবহার করা হয়। যৌন শক্তি বর্ধক টনিক তৈরিতে এই ছত্রাকের ব্যাপক ব্যবহার হয় বিধায় এই ছত্রাককে  হিমালয়ের ভাইয়াগ্রা বলা হয়।

বিবিসির একটি আরটিক্যাল থেকে জানা যায় ২০১২ সালে সর্বোৎকৃষ্ট মানের এই ছত্রাক এক পাউন্ড $50,000 পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে এর মুল্য বেড়েছে প্রায় ৯ গুন। উচ্চমূল্যের কারনে চারনভুমির দখল নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সংঘাত হয় প্রায়ই।  এই ছত্রাকটি পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৯৯৩ সালে যখন এক চৈনিক ক্রীড়াবিদ World Track and Field Championships এ তিনটি বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করেন। তার কোচ এই সাফল্যের পেছনে এই ছত্রাকটির শ্বাস প্রশ্বাস জনিত উপকারিতার কথা স্বীকারউক্তি করেন। সেই থেকেই পশ্চিমা দেশে ক্রীড়াবিদদের মাঝে এই ছত্রাক বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।  Pharmanex এর মত ঔষধ কোম্পানি গুলো ছত্রাকটি stamina-boosting supplement হিসেবে বাজারজাত করা শুরু করে।  দু'হাজার তিন সালের কথা। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে যখন Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) নামক শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পরে এই ছত্রাকটি রোগটির নিরাময়ে টোটকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে শোনা যায়।ফলে  হটাৎ করেই ছত্রাকটির ব্যবহার এত বেড়ে যায় যে অল্পকিছুদিনের মধ্যে সারা তিব্বতে এর মৌজুদ ফুরিয়ে যায়। 

 

লেখা: মাহবুব আলম চৌধুরী

পিএইচডি, মলিকুলার জেনেটিক্স

গবেষক, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়

Share this content: