আব্বাসউদ্দিন স্মরনে

আব্বাসউদ্দিন আহমদ

আব্বাসউদ্দিন আহমদ

ওকি গাড়িয়াল ভাই

কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে .

যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়

নারীর মন মর ছুইরা রয় রে .. (২বার )

ওকি গাড়িয়াল ভাই…

হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে

আর…কি কব দুস্কের ও জ্বালা…গাড়িয়াল ভাই

গাঁথিয়াছি কনমালা রে… ( ২বার )

ওকি গাড়িয়াল ভাই…

কত কাঁদি মুই নিদুয়া পাথারে রে …

ওকি গাড়িয়াল ভাই

কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে

ওকি গাড়িয়াল ভাই…

হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে ।”

অথবা

“ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে

ফাঁদ বসাইছে ফান্দি রে ভাই পুঁটি মাছো দিয়া

ওরে মাছের লোভে বোকা বগা পড়ে উড়াল দিয়া রে।।

ফান্দে পড়িয়া বগা করে টানাটুনা

ওরে আহারে কুংকুরার সুতা, হল লোহার গুনারে।।

ফান্দে পড়িয়া বগা করে হায়রে হায়

ওরে আহারে দারুন বিধি সাথী ছাইড়া যায় রে।।

আর বগা আহার করে ধল্লা নদীর পারেরে।।

উড়িয়া যায় চখুয়ার পঙ্খী বগীক বলে ঠারে

ওরে তোমার বগা বন্দী হইছে ধল্লা নদীর পারে রে।

এই কথা শুনিয়া রে বগী দুই পাখা মেলিল

ওরে ধল্লা নদীর পারে যাইয়া দরশন দিল রে।

বগাক্ দেখিয়া বগিক কান্দে রে

বগীক্ দেখিয়া বগা কান্দেরে।”

কল্পনার ঊর্ধ্বে জনপ্রিয়তায় থাকা দুটি গান । এর প্রমাণ মেলে দ্বিতীয় গানটির প্রকাশ কালে রেকর্ড-কোম্পানি ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ এর প্রচারপুস্তিকার নিম্নোক্ত লেখায়ঃ

“ উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে । এর কারন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই শ্রেণীর গানের বিশিষ্ট সুর ছাড়াও রচনাও অন্যতম আকর্ষণ । শিক্ষিত কবির কাব্যে যখন পড়ি, ‘এ পারে চক্রবাক, ওপারে চক্রবাকী...।’ তখন মনের আগে বুদ্ধি দিয়ে আমরা সব উপলব্ধি করি । কিন্তু অশিক্ষিত কবির গানে যখন দেখি- ‘ফান্দ পড়িয়া বগা কান্দে’- আর বিরহিণী বগীর মর্মব্যথায় সারা আকাশ ছলছল! তখন আর বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিরহের অতি সহজ প্রকাশ ভঙ্গী তিরের মতো সোজা এসে মানুষের মরমে বেঁধে । আমাদের মনে হয় নিরলঙ্কার এই বস্তুতান্ত্রিক প্রকাশ ভঙ্গীই গ্রাম্য গানের বিশেষত ভাওয়াইয়া গানের চাহিদার প্রথম কারণ ।”

আর এই ভাওয়াইয়া গানকে যিনি লালন করেছেন, তিনি হলেন অদৃশ্যমান মুকুট ধারণকারী পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদ । সেলিনা বাহার জামান এর ভাষায়- ‘পল্লীগীতি রাজ্যের দুয়োরানী এই ভাওয়াইয়া গানকে সর্বপ্রথম আব্বাসউদ্দিন আদর করে রাজ অন্তঃপুরে ডেকে আনলেন । তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম উপেক্ষিত দুয়োরানীর রূপশ্রী সুয়োরানীর চেয়ে কম নয়! এবং তার চেয়ে মুগ্ধ হলাম তার নিতান্ত সরল হৃদয়ের মাধুরীতে ।’

সুরের চারণ আব্বাসউদ্দিনের জন্ম ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলা ১০ কার্তিক ১৩০৮ সন । বাংলাদেশের উত্তরে রংপুর জেলা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ভূখণ্ড কুচবিহারের বলরামপুর গ্রামে তার জন্ম । আব্বাসউদ্দিন আহমদ এর বাবার নাম মৌলবী জাফর আলী আহমদ । জাফর আলী আহমদের প্রথম স্ত্রীর পাঁচ সন্তান, তাদের মধ্যে এক ছেলে আব্দুল গফুর মোহাম্মদ এবং চার মেয়ে । দ্বিতীয় স্ত্রী হিরামননেসার চার ছেলে- আব্বাসউদ্দিন, ড.আব্দুর রহমান, মনসুর আলী আহমদ, আব্দুল করিম এবং চার মেয়ে । জাফর আলী আহমদের বাবার নাম মৌলবী অলি মহম্মদ এবং দাদার নাম মৌলবী আশক মামুদ । আব্বাসউদ্দিনের এই পূর্বপুরুষেরা কুচবিহারের দিনহাটা (দ্বারিকামারী পেটেলা) অঞ্চলে বাস করতেন । পরবর্তীতে তারা কুচবিহারের বলরামপুর গ্রামে চলে আসেন । আব্বাসউদ্দীনের মা হীরামননেসার বাবার নাম সূর্য্য মহম্মদ এবং দাদার নাম খৈয়র মহম্মদ । উনাদের আদিনিবাসও বলরামপুরে ।

কুচবিহার অঞ্চলে সেসময় নামের আগে শেখ শব্দটা ব্যবহার করা হতো । তাই ছেলেবেলায় আব্বাসউদ্দিনের নাম ছিল শ্রী শেখ আব্বাসউদ্দিন আহমদ । শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা যেহেতু শেখ শব্দটা ব্যবহার করতো । তাই সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা আন্দোলন করে ওই শব্দটা পরিত্যাগ করে । ফলে আব্বাসউদ্দীনের নাম থেকেও তা উঠে যায় । বলরামপুর গ্রামের দৈর্ঘ্য প্রায় তিন মাইল, প্রস্থও প্রায় তিন মাইল । বাড়ীর পূর্ব দিগন্তে অবারিত ফসলের মাঠ, সবুজে ঘেরা ধানের ক্ষেত , তারপর আব্বাসউদ্দিনের অনেক স্মৃতি বিজড়িত সেই কালজানি নদী । এছাড়া দক্ষিণের খোলানে ছিল প্রচুর কলার গাছ ও ফুলের গাছ ।ছোটবেলা থেকেই তিনি ফুল ভালবাসতেন এবং নিজ হাতে গাছের যত্ন নিতেন আর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তা করার চেষ্টা করেছেন ।

আব্বাসউদ্দিনের সুর ও তাঁর ছোট ভাই আব্দুল করিমের লেখা গানেও বাড়ীর রূপরেখা ফুটে উঠেছে –

ও মোর কালা রে কালা

ও পারে ছকিলাম বাড়ী

কলা রুইলাম কালা সারি সারি রে কালা ।

কলার বাগিচায় ধিরিল সেই না বাড়ী রে......

.....................................................................................................................................................................বাড়ীটার দক্ষিণ খোলা পূর্বদিক কালা সাধুর দোলা রে কালা ।

সেই না দোলা শাওনে ভরে জলে রে ।।

 

আব্বাসউদ্দিন তাঁর স্মৃতিকথায় যেরকম বলেছেন ঠিক সেরকমই তিনি ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী ছিলেন । - “ছোট্টবেলা থেকেই মোরগের ডাক, শিয়ালের ডাক, ঘুঘুর ডাক, পায়রার ডাক, ব্যাঙের ডাক, কোকিল, দোয়েল, বউ কথা কও, স্কুলের যখন ঘণ্টা পড়ত, সেই ঘণ্টার শব্দের শেষ সুরটুকু-ঢং- এর অং... টুকু গলায় তুলে নিতাম ।”

“প্রজারা হাল বাইতে বাইতে, পাত নিড়াতে নিড়াতে গাইত ভাওয়াইয়া গান...। সেইসব গানের সুরেই আমার মনের নীড়ে বাসা বেঁধেছিল ভাওয়াইয়া গানের পাখি ।

ক ভাবী মোর বঁধুয়া কেমন আছে রে ?

তোর বঁধুয়া আছে রে ভালে

দিন কতেক কন্যার জ্বর গেইছে রে

ওকি কন্যা চায়া পাঠাইছে জিয়া

মাগুর মাছ রে ।

এ গানের সুর আমার সমস্ত সত্তায় এনে দিত আলোড়ন ।”

তখন পালাগান, যাত্রাগান হতো । সেখানেও গেয়েছেন তিনি । যাত্রাদলের সঙ্গীত মাষ্টার তাঁর গান শুনে তাঁর বাবার কাছে প্রস্তাব করলে, জাফর আলী আহমদ বলেন- “ ছেলে হয়তো ভবিষ্যতে গাইয়ে হবে, কিন্তু তাঁর আগে তো তাকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে হবে ।” আর যাওয়া হয়নি যাত্রাদলে । গ্রামের স্কুলেই আব্বাসউদ্দিনের লেখাপড়া শুরু ।

পরে তিনি কুচবিহার শহরে লেখাপড়া করেন । কুচবিহার শহরের বদ্ধ পরিবেশে তিনি হাঁপিয়ে উঠেন । তাই ফিফথ ক্লাসে (ক্লাস সিক্স) উঠে তিনি ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে চলে আসেন মহকুমার তুফানগঞ্জ এর ‘তুফানগঞ্জ’ স্কুলে । সেখানে আব্বাসের বাবা আদালতে ওকালতি করতেন । ফিফথ ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আব্বাস ফোরথ ক্লাসে উঠলেন । পুরস্কার বিতরণী সভায় গানের মহড়ায় প্রথম হয়ে সভায় গান গাইবার অনুমতি পেলেন । উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইলেন –

অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী খাওয়া ।

সভা শেষে গাইলেন -

সভা যখন ভাঙবে তখন

শেষের গানটি যাবো গেয়ে

হয়তো তখন কণ্ঠহারা

মুখের পানে রব চেয়ে ।

এ সভায়ই মন জয় করলেন পুরা তুফানগঞ্জ বাসীর । হয়ে উঠলেন সবার প্রিয় পাত্র । কিছুদিনের মধ্যে আব্বাসউদ্দিনের বাবা ওকালতি ছেড়ে চলে যান গ্রামে । কারণ দেড়শ বিঘা খাস আবাদি জমির বাইরেও তার পছিস-তিরিশ হালের পরিমাণ জমি আর পাঁচ হাজার বিঘা প্রজাপত্তনি জমি ছিল । এই সম্পত্তি দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার, পাইক, বরকন্দাজ রেখেও অসুবিধা হতো । তাই তার এমন সিদ্ধান্ত । আর তখন আব্বাসউদ্দীন কে চলে আসতে হয় হোস্টেলে প্রত্যেক ঘরে চারজন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা, তার মধ্যে দুজন হিন্দু আর দুজন মুসলমান ছাত্র । এখানে বন্ধুদের নিয়ে উনি একটা সেবা সমিতি গড়ে তুলেছিলেন । কারো বাড়িতে অসুখ হলে সেবা সমিতির সদস্যরা পালাক্রমে রাত জেগে রোগীদের শিয়রে বসে সেবা করতো । এ সময় আব্বাসউদ্দিন তুফানগঞ্জে একটি হিন্দু পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন । দারোগাবাবু ও তার স্ত্রী আব্বাসউদ্দিনকে নিজের ছেলের মতোই দেখতেন । বাড়ীর অভাব এখানেই ভুলে থাকতেন তিনি । পরবর্তীতে আই এ পড়ার সময়, আব্বাসউদ্দিন যখন পুলিশের দারোগা হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন, এই দারোগা বাবুই সেদিন সন্তাতুল্য আব্বাসের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাকে পুলিশের চাকরিতে ঢুকতে দেননি । নইলে হয়তো আজ আমরা আজকের আব্বাসউদ্দিন রে পেতাম না ।

কুচবিহার কলেজ থেকে আই এ পাস করে লখনউ মরিস মিউজিক কলেজে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আব্বাসের । ভেবেছিলেন গানও শিখবেন, সেই সঙ্গে বি এও পড়বেন । বাবা রাজী না হওয়ায় ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজ এ । সেখান থেকে বি এ পরীক্ষা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন বন্ধুর বাড়ি । হটাৎ খবর পেলেন বাবা মৃত্যুশয্যায় । দ্রুত বাড়ি ফিরে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন, তার বি এ পাসের বদলে যেন আল্লাহ্‌ তার বাবার জীবন ফিরিয়ে দেন । আল্লাহ্‌ তার দোয়া মঞ্জুর করেছিলেন । পরবর্তীতে অবশ্য অনেক বছর বেঁছে ছিলেন তার বাবা এবং অবশেষে ১৯৪৫ সালে ১০৫ বছর বয়সে মারা যান । ইচ্ছা থাকলেও তার আর বি এ পরীক্ষা দেয়া হয়ে উঠেনি । বন্ধু জিতেন মৈত্রের বিয়েতে কলকাতা গিয়ে যোগাযোগ হয় গ্রামোফোন কোম্পানির সাথে । সেখানে বিমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে দুটি গান দিয়ে তার প্রথম রেকর্ড বের হয় । শৈলেন রায়ের লেখা গান দুটি হচ্ছে-

 

স্মরণ পারের ওগো প্রিয়

তোমার মাঝেই আপন হারা

আকুল বাঁশীর সুরের খেয়ায়

দিয়েছো তাই তোমার সাড়া ।

এবং

কোন বিরহীর নয়ন জলে

বাদল ঝরে গো

কোন ব্যথিতের বুকের ব্যথায়

বাতাস ভরে গো ।

 

১ম গানটি ধীরেন দাস ও আব্বাসউদ্দিন দুজন মিলে সুর করেন আর ২য় গানটি ধীরেন দাস একাই সুর করেন। গান দুটি রেকর্ড এর সময় নাম করা গায়ক কে মল্লিক স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে তার উচ্চারণ ঠিক করে দিয়েছিলেন ।

অল্পদিনের মধ্যে পড়াশুনা ত্যাগ করে তিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন । তারপর আবার তার গান রেকর্ড হয় । শৈলেন রায়ের লেখা ‘আজি শরতের রূপ দীপালি’ আর জিতেন মৈত্রের লেখা ‘ওগো, প্রিয়া নিতে আসি তব দ্বারে’ গান দুটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল । এছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম এর অনেক গানে কণ্ঠ দেন তিনি । নজরুলের প্রথম ইসলামি গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গান রেকর্ড করার পর সাড়া ফেলেন সমগ্র মুসলিম সমাজে । আরও অভিনবত্বের মাত্রা যোগ হল নজরুলের ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ এই গানটিতে । কণ্ঠ দিলেন আব্বাসউদ্দিন । কলকাতায় বছর দুয়েকের মধ্যে আব্বাসউদ্দীন প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ।শুধু নিজেই গান গেয়ে যান নি, কুচবিহার থেকে শিল্পীদের নিয়ে এসেও ভাওয়াইয়া রেকর্ড করেন । শুধু গান নয়, চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। প্রথম ছবি ‘বিষ্ণুমায়া’ । এরপর তিনি আরও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেন । ছবির নাম ‘মহানিশা’, ‘একটি কথা’, ‘ঠিকাদার’ । ১৯২৯ সালে রংপুর জেলার ডোমার অঞ্চলের চিকনমাটি গ্রামের ফজিলউদ্দীন সরকারের কন্যা লুৎফুননেসার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । আব্বাসউদ্দিন তার স্ত্রীর নাম দিয়েছিলেন ‘আলেয়া’ । ১৯৩৩ সালের ৯ মে আব্বাসউদ্দিনের প্রথম সন্তান মুস্তাফা কামাল জন্মগ্রহণ করেন । নামটি রেখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম । তারপর ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন মুস্তাফা জামাল । বেশী দিন বাচতে পারেননি অল্প বয়সেই মারা যান । তারপর ১৯৩৭ সালে মুস্তাফা জামান আব্বাসী এবং সর্বশেষে কন্যা ফেরদৌসি রহমান । ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত কলকাতার বেনেপুকুর লেনের বাসায় আব্বাস পরিবার ছিলেন । ঢাকায় এসে প্রথমে নারিন্দায়, তারপর পাতলা খান লেনে থাকতেন । পরে ১৯৫৪ সালে আসেন পুরানো পলটনের বাড়িতে । আব্বাসউদ্দীন শুধু মাত্র তার সন্তানদের রেখে যান নি। যেন বাংলাদেশ এর জন্য রেখে গেছেন এক একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র । যা সর্বজনবিধিত ।

কলকাতায় এসে আব্বাসউদ্দিনের প্রথম চাকরি হয়েছিল ৪৫ টাকা বেতনে ডি পি আই অফিসে । পরে ওই অস্থায়ী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাংলা সরকারের কৃষি দপ্তরে চাকরি নেন । এ চাকরিতে থাকা অবস্থায় উনি বিভিন্ন জায়গায় গান ও রেকর্ড করার সুযোগ পেয়েছিলেন । এখানে প্রায় বারো বছর চাকরি করার পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এর কথায় তিনি যোগ দেন বাংলা সরকারের প্রচার বিভাগে- ‘রেকর্ডিং এক্সপার্ট টু দ্য গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল’ পদে। এখানে পাঁচ বছর চাকরি করেছিলেন উনি । এই সরকারের অধীনে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার জন্য বহু প্রচারকাজে অংশ নিয়েছেন । আর এই প্রচার কাজের জন্য আব্বাসউদ্দিনকে বিভিন্ন ধরণের গানও রেকর্ড করতে হয়েছে । এসব রেকর্ডে কেউ কথিকা লিখে দিয়েছেন, কেউ কণ্ঠ দিয়েছেন ।

চিত্ত রায় , শৈলেন রায়, সাঈদ সিদ্দিকী, আব্দুল করিম, বিপিন গুপ্ত, কালোবরণ দাস, কোমল দাশগুপ্ত, টোপা, বিমলেন্দু কয়াল, জিতেন মৈত্র, রাজাবাবু, নীলিমা সান্যাল, নাজির আহমেদ, প্রভা দেবী, ঝর্না দেবী এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য । ঢাকায় এ সময় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় । নজরুল এ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখলেনঃ ‘হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই’

আর ‘ভারতের দুই নয়ন তারা হিন্দু-মুসলমান ।’ আব্বাসউদ্দিন ও মৃণাল কান্তি ঘোষ মিলিতভাবে এ দুটি গানের রেকর্ড করেন । সরকারের প্রচার দপ্তর থেকেও রেকর্ড বের করলেন আব্বাসউদ্দিন –

 

ও ভাই হিন্দু-মুসলমান

ভুল পথে চলি দোঁহারে দু’জনে কোরো

নাকো অপমান ।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সং পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট নামে একটা নতুন সরকারি দফতর প্রতিষ্ঠিত হয় । আব্বাসউদ্দীন অতিরিক্ত অরগানাইজার হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এই পদেই কর্মরত ছিলেন । এরপর ঢাকায় এসে মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তত দুশো জনসভায় গেয়েছেন উদ্দীপনামূলক গান । শুধু দেশেই নয়, সঙ্গীতের কথা বিশেষত পল্লীগীতীর কথা বিদেশেও নিয়ে যান তিনি । ১৯৫৫ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এ সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন । ভাটিয়ালি গানের পাশাপাশি আধাঘণ্টা পল্লীগীতি নিয়েও আলোচনা করেন। পরের বছর ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত কাউন্সিলের অধিবেশনে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তিনি যোগ দিয়ে ছিলেন । আব্বাসউদ্দিন গাইলেন গান আর তার ছেলে মুস্তাফা কামাল করলেন পল্লিগিতি নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ। অতঃপর আব্বাসউদ্দিন লন্ডনে ছেলের সাথে কিছুদিন অবস্থান করেন । এর কিছুদিন আগে থেকেই তিনি রোগাক্রান্ত ছিলেন । লন্ডনের হাসপাতালে তাই চিকিৎসার জন্যও ভর্তি হন তিনি । তারপর ফিরে আসেন দেশে । জীবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত কাটান পুরনো পলটনের বাসায় । শুয়ে থেকেই সব কাজ করতেন তিনি । এভাবে কয়েকবছর কাটানোর পর ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন । সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা দিবস ১৯৮১’ মরণোত্তর পুরস্কারে ভূষিত হন । সাহিত্যেও পদচারনা রয়েছে এ শিল্পীর তার প্রমাণ মেলে তার “দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা” বইয়ে । যা তিনি লন্ডনে চিকিৎসারত অবস্থায় লিখেছেন । এছাড়া তার অপ্রকাশিত কিছু লেখাও রয়েছে । সত্যিই গানে গানে ভরিয়ে তুলেছেন মন, জাগিয়ে তুলেছেন দেশাত্ববোধ, জাগিয়ে তুলেছেন ভ্রাতৃত্ববোধ, জায়গা করে নিয়েছেন বিশেষত উত্তরবঙ্গ তথা চিলমারী ও সমগ্র বাঙালীর চিত্তের মণিকোঠায় ।

 

এ. এস. এম. সাজ্জাদুল ইসলাম

[তত্ব ও সূত্রঃ আব্বাসউদ্দিন আহমদ/ সেলিনা বাহার জামান]

Share this content: